অনুপম
বলছি
।। কবি
নীরেন্দ্রনাথ চলে গেলেন চিরস্মৃতির দেশে। দৈত্যদের পায়ের ছাপ দ্রুত মুছে যাচ্ছে
বাংলা কবিতা থেকে। আমরা কি বামনত্বের যুগে প্রবেশ করেই ফেললাম?
সমস্যা
হয়ত উচ্চতা নয়। সমস্যার শুরু হয় যখন কেউ বুঝে ফেলে কবিতা কী করে লিখতে হয়। সে
খুঁটিয়ে বুঝে নেয় উৎপলকুমার বসু কীভাবে তাঁর সিনট্যাক্স রচনা করেছেন, কী কী প্রকারে মণীন্দ্র গুপ্ত তাঁর কবিতায় রহস্যজাল বুনেছেন, বিনয় মজুমদার কেমন নগ্ন আর নির্জন হয়ে উঠেছেন। সে বুদ্ধিমান। সে জানে কতটা
একাগ্রতা লাগে। সে স্টাডি করতে থাকে, অন্যরা ভাবে সে লিখতে
শুরু করেছে। তার কবিতা ছাপা হতে থাকে। সম্পাদকদের সেই কবিতা না ছাপার কারণ নেই।
যারা বাংলা কবিতার হাড়মজ্জা জানে না, কিন্তু কবিতা ভালবাসে,
সে তাদের হাততালি এবং অভিনন্দনও পেতে থাকে। সিনিয়র কবিরা হ্লাদিত হয়,
কারণ সে তাদের মশালই হাতে তুলে নিয়েছে। খুব দ্রুত তার নামের সঙ্গে
যুক্ত হয় ‘প্রতিশ্রুতিবান’, ‘সম্ভাবনাময়’
ইত্যাদি আখ্যা। সে মঞ্চে ওঠে, মঞ্চ থেকে নামে,
মাটিতে পা রাখার সময় খুব একটা পায় না। দশক কেটে যায়। হঠাৎ
ক্যালেন্ডারের একটা তারিখে তার পা বেঁধে যায়, সে হুমড়ি খেয়ে
পড়ে। দেখতে পায়, তার পরের প্রজন্মের সম্ভাবনাময় এবং
প্রতিশ্রুতিবান কবিরা এসে গেছে। তার কবিতা শেখার ফাঁকে কবিতা লেখা আর হয়নি। কবিতার
মনোযোগী কিন্তু অসফল ছাত্রের মতো মার্কশিট হাতে সে বেরিয়ে যায়, কোথায় যায়, কেউ খবর পায় না। ওই তারিখটা তার
এক্সপায়ারি ডেট ছিল।।
আরো
বলি। আপনি কবিতা লেখেন। অনেকদিন লিখছেন? আমার এই কথাগুলো মন দিয়ে
শুনুন। আপনি একটা পত্রিকায় লিখলেন। এমন নয় যে আপনি প্রশংসার প্রত্যাশা করলেন।
নিন্দা আপনার প্রাপ্য নয়। আপনি চাইবেন মানুষ কবিতাগুলো নিয়ে কথা বলুক। এটাও হয়ত
আশা করা ঠিক নয়। কিছু মানুষ আপনাকে নিয়ে কথা বলবে না। তারা পত্রিকা প্রকাশ হওয়ার
আগেই আপনার ব্যাপারে নীরব হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা ঠিক করে রেখেছে কাকে নিয়ে
কথা বলবে। আপনি দেখবেন পত্রিকায় চিঠি এল, বা সম্পাদককে
ব্যক্তিগতভাবে জানানো হল শুধু সেই কবির সম্পর্কেই। যেন আপনি লেখেনইনি। যেন আপনার
কবিতা তারা পড়েইনি। এটা কিন্তু নয়। তারা আপনার কবিতাটাই সবচেয়ে মন দিয়ে পড়েছে।
কবিতার জগতে যেমন দুটো শব্দের মধ্যে কবিতা লুকিয়ে থাকে, এই
লোকগুলির নীরবতার মধ্যে লুকিয়ে আছে আপনার সাফল্য। এমনও হতে পারে, সেই কবিকেও ব্যক্তিগতভাবে জানানো হল- “আরে তুই যা
লিখেছিস, ও তোর সামনে দাঁড়াতেই পারেনি।” এটা পলিটিক্স। পলিটিক্স অনেক প্রকারের হয়। এটা স্নায়বিক পলিটিক্স। এটা
নিন্দার চেয়ে অনেক কুশলী পদক্ষেপ। নিন্দায় যখন কাজ হয় না, এই
পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। এটা তারাই করে, যারা আপনার প্রতি
ঈর্ষান্বিত, কিন্তু আপনার প্রকাশ্য বিরোধী নয়। নিজের
ক্ষেত্রে দেখেছি গত কুড়ি বছরে বহুবার। ‘বাক্’-এও দেখেছি কিছু কবির ক্ষেত্রে ঘটতে। এমনও দেখেছি, ‘বাক’-এর কোনো সংখ্যায় দুজন কবির মধ্যে তুলনা করা হল,
এর ফলে তৃতীয় কবির সামনে গোলপোস্ট উন্মুক্ত হয়ে গেল। শেষ অবধি এগুলো
তাৎক্ষণিক ব্যাপার। কিন্তু, বিরক্তি এবং অস্বস্তি কবে আর
চিরকালীন হয়েছে! এগুলো তো কবিতা নয়।।
অনুপম মুখোপাধ্যায়
পরিচালক : বাক্