।। ম্যানিকুইন : ১টি পুনরাধুনিক আখ্যান ।। অনুপম মুখোপাধ্যায় ।।



।। আখ্যানে শুরুতেই চা উল্টে গেল। গাঢ় সেই তরল যা রং। যাকে চা দিয়ে অনায়াসেই ব্যাখ্যা করা যায়। ছড়িয়ে গেল টেবিলের কিছু অংশ জুড়ে। একটু পরেই ওর মধ্যে বদল আসবে। ওর ভিতরকার জল চলে যাবে বায়ুমণ্ডলে। দাগ। ধীরে ধীরে গাঢ়তর হবে। একটু বিবমিষা মাখবে। ওই চা আমার খাওয়ার কথা ছিল। এখন সেটা আর বিশ্বাস হচ্ছে না। ওকে খাওয়ার কথা ভাবলেই আঁত থেকে ছিটকে আসছে ইপিকাক্‌ ইপিকাক্‌ রব। শিরা দেখা যাচ্ছে। আবছা উপশিরা দেখা যাচ্ছে সেগুলোর রং আরেকটু গভীর তাদের ভিতর দিয়েই যেন শুষ্কতা আসছে ওর মধ্যে। কবি স্বদেশ সেন বলেছিলেন শুকনো জলের শুকিয়ে আসা ১ বিষয়। এই গল্পের শুরুতে চা উল্টে যাওয়া থেকে যে বিষয়ের সূত্রপাত হল তার অবসান কোথায়? চায়ের দাগ খুব প্রতিমাবানবার লেগে গেলে ওঠানো মুশকিল। একে শুকোতে দেওয়া যাবে না।।


         আমার বিষয়? মৃত্যু।”
         “চা পড়ে যাওয়ার সঙ্গে মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই।”
         “মৃত্যুর আগে আমার বসিও না। নিজেকে বসিও না।”
         “মৃত্যু নয়। বিষয়ের আগে নিজেকে বসিয়েছি।”
         “চা কোনো বিষয় নয়।”
         “কেন? চা কি কিছু নয়? তার কি ক্ষয় নেই? ব্যয় নেই? অপচয় নেই”
         “উল্টে যাওয়া চায়ের ছবি সাদাকালোয় তোলো। দেখবে সে কেমন তার নিজের দাগ আর ছড়িয়ে যাওয়াকে পেরিয়ে অন্য কোথাও চলে যায়।”
         “তুললাম।”
         “কী বুঝলে?”
         “রংকে সরিয়ে দিলে ছবি আরো রঙিন হয়ে যায়।”
         “কঙ্কালের মতো?”
         “আর ১বার চা বসাই?”
         “সকাল হয়ে গেছে। আগে পুতুলগুলোকে বাইরে টাঙিয়ে দাও। কোমর অবধি।”
         “বাকিটা? কোমরের উপরটা লাগবে না?”
         “এখনই লাগবে না। সকালে লাগবে না। টি-সার্ট বিক্রি করব বিকেলের পর থেকে।”
         “তুমি এসো। টাঙানোর ছবি তুলে রাখো।”
         “ইতিহাসের গ্যারান্টি ছাড়া ১টা পুতুলও কি তুমি টাঙাবে না?”
         “আমার বিষয় মৃত্যু।”
         “আর ১বার চা বসাই?”



।। দোকানের বাইরে যেমন রোদ ওঠে। লেখার বাইরেও ওঠে। সাদা। হলদে। লালচে। মেঘের আঁকিবুঁকি। ১টা-দুটো পাখির খালি পালক ভেসে ভেসে নেমে আসে রোদের ভিতরে। এমন দিনে বন্ধুরা মদের দোকানে ডেকে জীবনের গল্প শুনতে চায়। সেই গল্পে ঘটনা যত কম থাকে। নেশা তত জমে।।

         “কেন, আমাকে সবকিছু বলতে হবে কেন?”

।। বলতে হবে কারণ আমাদের জীবনের ভৈরব সত্যিগুলোকে আমরা আমাদের ছাপোষা দিনগুজরান দিয়ে মাপতে যাই আর তারা গলে যায় আমাদের আঙুলের ফাঁক দিয়ে চোখের আলোর মতো প্রতিটি হৃৎস্পন্দন জীবনের না-দেখা সবগুলো বাঁক সবগুলো মোড় আর আমি বা আপনি তো জানিই পাঠক আমাদের জীবনের বাহিরের দিনগুলো কেমন চলে গেছে যেন ভুলে যাওয়া ১-১টা স্বপ্ন ছেঁড়া ময়লা বালুচরী জানালার পাশে কখনও না-বসা ১-১টা চেয়ার খুব পুরনো সেগুন কাঠের কালো হয়ে যাওয়া হাতল সামনে ল্যান্ডস্কেপ কাঠি হয়ে দুলছে অসম্ভব স্থিরতা কল্যাণময়তা আর নিঝুমতা নিয়ে পড়ে আছে ১-১টা ধুলোমাখা অপ্রভ ঘর।।

“যে দিন এখনও যায়নি, সে দিন আমার স্মৃতি হয়েই ভালো আছে।”
“কিন্তু সেও তো অভিজ্ঞতা হবেই ১ দিন।”
“জানি। অভিজ্ঞতাই স্মৃতির মৃত্যু।”
‘জ্ঞানপাপী হয়ে থাকবে আর কদিন?”
“জ্ঞানবাপী মনে করিয়ে দিলে।”
“সে কী?”
“বেনারস। বেনারস যাব ১ বার।”
“আজও যাওনি?”
“না। বেনারস আমার বুকে বিষম পাথর হয়ে আছে। মহাভারতের আমলের শহর জানো তো? ওখানকার রাজকুমারী ভানুমতীকে দুর্যোধন বিবাহ করেছিলেন কর্ণের সাহায্যে তুলে নিয়ে গিয়ে।”
“অথচ আজও যাওনি।”
“ভয়ে যাইনি।”
“কী ভয়?”
“যদি গিয়ে বেনারসকে মেরে ফেলি! যদি মেলাতে না পারি! যদি আমার হাতে তার রক্ত লেগে যায়!”
“কিংবা যদি মগনলাল মেঘরাজের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তোমার? কিংবা দেখলে হরিহর বাঁড়ুজ্জে ঘরে ফিরছে অপুর হাত ধরে, কথকতা সেরে?”
“হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ কিংবা যদি জানতে পারি রাস্তায় শুয়ে থাকা ১টা প্রচণ্ড ষাঁড়ের উপর দিয়ে হাইজাম্প করার সাবলীল সাহস আমার আদতে নেই!”
“যখন ১দল স্কুলবালিকা দৌড়ে আসছে তোমার দিকে। একটা সরু গলি বরাবর...”




।। ঠিক এতদূর পড়ার পরেই ১টা মশা এল আপনার বুকের কাছে। ধীরে বসল আপনার গলায়। নিপুন ড্রাকুলার মতো হুল বেঁধাল। রক্তশোষণের মধ্যপথে আপনি ১টা “উহ্‌” করলেন। মশাটা উড়ে পালাচ্ছে। আপনি পত্রিকাটাকে পাকালেন। সপাটে মারলেন। দেওয়ালে আপনার পবিত্র ও ব্যক্তিগত রক্তের মধ্যে অতৃপ্ত মশাটা স্থির হয়ে গেলঅনলাইন পত্রিকায় সেই সুবিধা নেই। লোডশেডিং হয়ে গেলে হাওয়া খেতে পারবেন না পত্রিকাটাকে পাখা বানিয়ে। ভাবতে বেশ লাগে। এই লেখা ১টা পত্রিকার অংশ হিসেবে আপনাকে গরমে আরাম দিচ্ছে। রক্তক্ষয়ের প্রতিশোধ দিচ্ছে। কিংবা সঙ্গমরত আপনার অস্থির বালিশের তলায় এই লেখা চাপ খাচ্ছেচুপচাপ। আপনার মৃদু গোঙানি ও ক্ষণিক শীৎকার শুনছে। এই সবই ভালো লাগে। ভাবতে। কিন্তু এটাও মনে হয়- যদি প্রেসে গিয়ে পাতার সংখ্যা ভুল ছাপা হয় আর লেখকের নাম ঘুলিয়ে যায়! হয়ত আপনি সবকিছুর মধ্যে এই লেখাটাই পড়লেন, কিন্তু অন্য কারও নামে। আর আমার নামটা থাকল অন্য কারও লেখার উপরে। হয়ত এরকম ১টা লেখার উপরে-

বাবুরাম সাপুড়ে

সকাল। এসেছে ১
ভোরের সাপুড়ে
রবারগাছের পাশে। বাবুরাম
একা
সরু ছায়া বাঁকা কিছু
গাঢ়। সাদা। রোদ
খেলা কী দেখাবে শেখাবে
অত ফ্যাকাশে শরীর

।। আপনি কি ১ পলক দেখেই বলবেন এটা অনুপম মুখোপাধ্যায়ের লেখা? আপনি কি জানেন অনুপম মুখোপাধ্যায় কেমন লেখে? হয়ত আপনি জানেন অনুপম তার ছেলেবেলায় শেয়ালের গর্তে হাত ঢুকিয়ে শেয়ালের ছানা বের করে আনত। আমি অবিশ্যি জানি না অনুপম মুখোপাধ্যায় কেমন লেখে। কেন লেখে। সূচিপত্রে যদি মলয় রায়চৌধুরীর লেখার উপরে অনুপমের নাম ছাপা হয়, পৃথিবীতে কিছুই কি উলট পালট হবে? যদি জয় গোস্বামী আর রণজিৎ দাশের লেখায় ওঁদের নাম এদিক ওদিক হয়ে যায়? ১টা পত্রিকা তার ছাপাখানার উপরে ঠিক ততটাই নির্ভরশীল যতটা ১টা সমাজ তার সংবিধানের উপরে। সকল নৈতিকতা, সকল অবস্থানকে ভেস্তে দিতে পারে ছাপাখানার এদিক সেদিকএমনকি বাঁধাইয়ের গোলমাল। এই আখ্যানকবিতার পৃষ্ঠাগুলো আপনার কাছে যে পৌঁছে গেছে, এ নিছক সু-সংযোগের ব্যাপার। যেমন একজন রমণী তাঁর বাই-সাইকেল নিয়ে চড়েন নৌকোয়, হাতল ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন, মুখে লাজুক হাসি, নৌকো থামলে ভাড়া মিটিয়ে সাইকেল ঠেলে ওঠেন বাঁধের উপরে সিঁড়ি বেয়ে, শরীরের খাঁজ আর ভাঁজগুলো ঘামে ছেয়ে যায় ওই যে দৃশ্য-নৌকোর উপরে রাখা দৃশ্য-সাইকেলের ভার। ধীর শীর্ণ দৃশ্য-নদী। সে-ই হল সু-সংযোগ। সাইকেলের যে কোনো সিটে যৌনাঙ্গের সংযোগ এবং অভ্যাস লেগে থাকে।



।। ঠিক এতদূর লেখার পরে ভাবছি যদি কোনো পাঠক বিরক্ত হয়ে এই লেখাসমেত পত্রিকাটাকে আছাড় মারেন তাঁর মেঝেয়, এই লেখা কি খণ্ড খণ্ড হয়ে যাবে? তার ভিতরের যাবতীয় কারসাজি কলকব্জা চুরমার হয়ে ছড়িয়ে যাবে? ১টা বর্ণচ্ছটাও কি দেখা দেবে না? আশা রাখি, দেবেই। এই লেখা হয়ত তখন পাঠকের রক্ত হিম করে অপার্থিব বলে উঠবে –

“মৃত্যুর পরে কী, আমি জানি। তুমি জানো না।”

আপনি অপমানিত বোধ করবেন কি? সেই যে অ-আ-ক-খ থেকে যাত্রা শুরু করে কত কত হাজার লক্ষ কোটি শব্দ আর অক্ষর পেরিয়ে আপনি আপনি হয়ে আমার এই আমার-হওয়া লেখায় এসেছেন, আপনাকে ঘিরে আছে সারা পৃথিবীর লেখা, সব দিক থেকে ধেয়ে আসছে অসংখ্য লেখা এবং লেখা-লেখা ভাব, আজ আপনি বিশ্বাসই করতে পারবেন না এই পৃথিবীটা সেই লোকের কাছে কেমন যে লিখতে-পড়তে শেখেনি। লিখতে-পড়তে শেখা দুজন মানুষের মধ্যে যে দূরত্ব, সেটাও কি আপনি কখনও মাপতে পেরেছেন, মাপতে চেয়েছেন? পেচ্ছাপখানার দেওয়ালে পুরুষরা যে যোনি আঁকে, মহিলারা আঁকে লিঙ্গ, ইস্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি-কফিশপের দেওয়ালে দরজায় টেবিলে বেঞ্চিতে যে নাম খোদাই করতে চায়, কিছু লিখতে চায়, আসলে তো বাইরের পৃথিবীটাকে ঠিক সে-রকমই ফাঁকা করে ফেলতে চায় যতটা তাদের নিজের অন্তর। ১-১জন গুহামানব গুহামানবীর মতোই আজকের লেখক ঝাঁপিয়ে পড়ে সাদা পাতা বা ফাঁকা মনিটরের উপরে, ভরাতে নয়, বাহিরের ফাঁকাতা আর নিজের ফাঁকাতার মধ্যে ১টা সাম্য প্রতিষ্ঠা করার তেষ্টা সম্বল করে। দেওয়াল-দরজা-চেয়ার-টেবিল সবকিছু থেকে দুঃস্বপ্নকে ঢেকে দিতে চায় কখনও নিজের নাম লিখে, কখনও অপরের যৌননাম এঁকে।



         “মৃত্যু নিয়ে অত কথা বোলো না।”
         “কেন? আমার কি বয়স হয়নি? কত বয়স জানো আমার?”
         “তবু, বোলো না
         “কেন?”
         “মৃত্যুর কোনো বয়স হয় না। সময় হয়।”
         “সময় তো মানুষেরই আবিষ্কার!”
         “মৃত্যুও কি নয়?”

                                                            (ছবি- অনুপম মুখোপাধ্যায়)

6 comments:

  1. আমি কিছু বলার মত ভাষা পাইনি। শুধু পড়েছি। আরো ,আবার পড়ব। এর পরের ধাপটা কি আমি বুঝতেই পারছি না। শুধু পড়তেই ভালো লাগছে।

    ReplyDelete
  2. আখ্যান ভেবে পড়তে বসলে মেলে না হিসেব। আখ্যান মিশে যাচ্ছে সলিলকিতে। নতুন একটা ফর্ম গড়ে উঠতে পারে ভবিষ্যতে এখান থেকেই। তবে এই ধরনের কাজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে চোখে পড়েনি অতীতে এমন নয়। রংকে সরিয়ে নিলে যেমন আরও রঙিন হয়ে যায় ছবি চেনা ফর্মকে সরিয়ে দিতেই তেমন ভিড়ের মধ্যে আরও উজ্জ্বল হয়েছে কাজটা।

    ReplyDelete
  3. আপনার প্রত্যেকটা লেখাই পড়ি এটাও পড়লাম একটা বোধের ভিতর আচ্ছন্ন থাকতে থাকতে লেখাটা কখন শেষ হয়ে যায় তখনও আচ্ছন্ন থস্কি অপরূপ এক ভাললাগার সংগে থাকি অনেকক্ষণ

    ReplyDelete
  4. খুব ভালো লাগল।

    ReplyDelete
  5. সাংঘাতিক ভালো লেখা। ভেতরে খোদিত হয়ে চলেছে এক একটি শিল খোদাইয়ের মত । দুঃখেও চোখে জল আসবে না।

    ReplyDelete
  6. একবার পড়লাম। বারংবার পড়ার মতো

    ReplyDelete