জলট্যাঙ্কের গলির কাছে এসে
থমকায় রঞ্জন। লোকে একেবারে লোকারণ্য গলির মুখটায়। বাইকের চাবি বন্ধ করে সবে আঁচ
করার চেষ্টা করছে ব্যাপারটা। তখনই ভিড় ঠেলে গলি থেকে বেরিয়ে আসে তালঢ্যাঙা মিশকালো
লোকটা। হাত তুলে চিৎকার করতে থাকে প্রায়, আপনারা প্লিজ ফাঁকা করুন একটু রাস্তাটা।
গাড়ি এসে পড়বে এখনই...
কখন হল কেসটা বিনোদদা? ঘুমের মধ্যেই?
একটু ভেতরে যেতে দিন না বিনোদদা...
দেখে আসতাম একবার ডাক্তারবাবুকে...
একটু ধৈর্য ধরুন আপনারা, গলার শিরা ফুলে উঠছে প্রায় বিনোদের, বের
করে আনতে দিন ডাক্তারবাবুকে। সবাই দেখতে পাবেন...
মারা গেলেন ডাক্তার সুধাকান্তি মৈত্র! আর এই লোকটাই তাহলে বিনোদ।
ডাক্তারবাবুর কম্পাউন্ডার। বিনোদের মোবাইল নাম্বারও বোধহয় আছে তার কাছে। অমিয়
দিয়েছিল সেবার। কাছেই মন্দিরতলায় বাড়ি অমিয়র। আগের রাতে মুড়িঘণ্ট খেয়ে সকাল থেকে
গলাবুক জ্বলে যাচ্ছিল মা-র। দুপুরে খেতে পারল না প্রায় কিছুই। ঘরে থাকা
হোমিওপ্যাথির গুলিতে কাজ তো হলই না, বিকেল থেকে শুরু হল চোঁয়া ঢেকুর। অমিয়কে ফোন
করেছিল রঞ্জন। সুধাকান্তি মৈত্র কখন বসেন জানতে। সেদিন আবার শ্বশুরবাড়িতে অমিয়।
নাম্বারটা দিয়ে বলেছিল, বিনোদকে ফোন করে নে বরং। ডাক্তারবাবুর কম্পাউন্ডার...
শেষ পর্যন্ত দেখানো হয়নি অবশ্য আর সুধাকান্তি মৈত্রকে। সাড়ে আটটার
পর বাড়ি ফিরতেন ডাক্তারবাবু। অতক্ষণ বসে থাকার পরিস্থিতি ছিল না।
ঘুমের মধ্যেই মারা গেছেন সেই সুধাকান্তি মৈত্র। তাই এত ভিড় এখানে।
অবশ্য সুধাকান্তি মৈত্রর জন্য লোক জমা আশ্চর্য নয় কিছুই। ভাল ডাক্তার বলে আলাদা
নাম তো ছিলই। উপরন্তু ফি সোমবার সকালে তাঁর একতলার চেম্বার গিজগিজ করত গরিব
রুগিতে। দাতব্য চিকিৎসার পাশাপাশি ফ্রিতে স্যাম্পেল ওষুধ অবধি দিয়ে দিয়েছেন কত
লোককে। শিপ্রার মতো লালবাতি জ্বালতে বসা দোকান লালে লাল হয়ে গেল স্রেফ তাঁকে বসানো
শুরু করেই। রাতবিরেতে আচমকা যমে মানুষে টানাটানি লাগলে প্রথমেই যেসব ডাক্তারদের
নাম মনে আসে লোকজনের জলট্যাঙ্কের গলির এই ডাক্তারবাবুর নামটা এতকাল ছিল তাঁদের
তালিকার একেবারে উপরেই। আর জি কর হাসপাতালের সঙ্গেই বোধহয় দীর্ঘদিন জড়িত ছিলেন
সুধাকান্তি মৈত্র।
বলতে নেই, এই চল্লিশ ছুঁইছুঁই জীবনে নিজের জন্য ডাক্তারের চেম্বারে
খুব কমই হাজিরা দিতে হয়েছে রঞ্জনকে। শরীরে বড়সড় কাটাছেঁড়াও নেই তেমন কিছুই।
সুধাকান্তি মৈত্রর নামটা যতদূর মনে পড়ছে প্রথম শুনেছিল ক্লাস এইটে। সাতাশ বছর হয়ে
গেল তাহলে দিদুর মারা যাওয়ার! তা হবে, বছর যায় না জল যায়! ক’দিনের জন্য বেড়াতে
এসেছিল দিদু। রবিবার সন্ধ্যার বাংলা সিনেমা শেষ করে দুধ-রুটি নিয়ে বসেছিল আন্দাজ
সাড়ে আটটা হবে। একটু আগেই বাঁকে করে রাতের জল দিয়ে গিয়েছে ভারী। শেষ রুটিটা আর
খাওয়া হয়নি। জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছিল কথা। মা জিজ্ঞাসা করছিল, কী হল মা? কোথায় কষ্ট
হচ্ছে তোমার?
মিনিট কুড়ি-পঁচিশের মধ্যে বাড়ি লোকে লোকারণ্য। মোবাইলের যুগ তখন নয়
ঠিকই। কিন্তু ল্যান্ডফোন থাকতই পাড়ার কোনও না কোনও বাড়িতে। এদিক-ওদিক থেকে আগেভাগে
চলে এসেছিল বাড়ির ব্যাটাছেলেরা। পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া
হয়েছিল দিদুকে। বছর তিনেকের ব্যবধানে সেটা দ্বিতীয় দফার অ্যাটাক। দিশাহারা হয়ে
গিয়েছে মা। সমানে ঘরবার করতে করতে অমন দিনেও থেকে থেকেই রঞ্জনের চোখ আটকে যাচ্ছিল
দোরগোড়ায় জড়ো হওয়া সাইকেলগুলোর দিকে। চার মাসও হয়নি নতুন বিএসএ ডিলাক্সখানা কিনে
দিয়েছে বাবা। তারপর থেকেই কোথাও তিন-চারটে সাইকেল একসঙ্গে দেখলেই মনে মনে হিসেব
শুরু করত রঞ্জন। হিরো সাইকেল শক্তপোক্ত। এভন সাইকেল স্টাইলিস। পৃথিবীর শেষ র্যালে
সাইকেলটা বোধহয় চালায় দাদুই...
ছোটমেসো আর মেজোজ্যাঠা বেরিয়ে গিয়েছিল ডাক্তার ডাকতে। খেতে বসে
গিয়েছিলেন সুধাকান্তি মৈত্র। একানব্বই সালে সাড়ে ন’টা একেবারে কম রাত ছিল না।
দাঁড়িয়ে না থেকে হিমাংশু ডাক্তারকে ডেকে এনেছিল মেজোজ্যাঠা। তারপর তো সেই রাতে এক
হইহই রইরই কাণ্ড। অ্যাম্বুলেন্সে খবর দেওয়া। হিমাংশু ডাক্তারের রেফারেন্সে দিদুকে
কল্যাণীর জওহরলালে নিয়ে গিয়ে অ্যাডমিট করানো। জীবনে সেই প্রথম অত কাছ থেকে পরপর
অতগুলো ঘটনা দেখেছিল রঞ্জন।
চারদিনের মাথায় সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর শ্মশানে দাঁড়িয়ে বলছিল
ছোটমেসো, সেদিন রাতেই খটকা লেগেছিল আমার। সুধাডাক্তারের বাড়ি গিয়ে যখন শুনলাম খেতে
বসে গেছেন ডাক্তারবাবু। বলিনি কিছু আর মুখ ফুটে...
ততক্ষণে একটু ধাতস্থ হয়েছে মেজোমাসি। বলছিল, আমারও কু গেয়েছিল মনটা
তোমাদের কথা শুনেই।
আজকাল তো এসব আর কেউ মানে না মেজদি...
না গো, আছে এমন অনেক জিনিস...
এই ছোট্ট ঘটনাটার সুবাদেই মনে গেঁথে গেল সুধাকান্তি মৈত্রর নামটা।
সাত-আট বছর পরের কথা। পার্ট টু-তে ড্রপ দিয়েছে সেবার। এতকাল পরেও
ছবির মতো মনে আছে দিনটাকে। বর্ষাকাল। কয়েকদিন ধরেই বাজার ইলিশে ইলিশে ছয়লাপ। আর
সেসব মাছ আজকের মতো সাড়ে তিনশো-চারশো ওজনের ছিল না। ইলিশের তেল, মুড়ো দিয়ে কচুশাক
আর ইলিশ ভাপা দিয়ে দুপুরে জমিয়ে খেয়েদেয়ে লম্বা হয়েছে তক্তপোশে। চোখের সামনে একটা
বই খুলে নিয়ে। এতদিন পরেও মনে আছে বইটার নাম। ‘ছোঁয়াচ’। দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের
উপন্যাস গোগ্রাসে গিলছে তখন। তার আগে আগেই শেষ করেছে ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের
বন্ধু’ আর ‘দ্বারবাসিনী’। মাথায় চেপেছে সাহিত্যচর্চার ভূত। কলেজ কেটে মাঝেমধ্যেই
চলে যাচ্ছে নাকের ডগায় কলেজ স্ট্রিটে। কলকাতার দু’-একটা লিটল ম্যাগাজিনে গল্পও
বেরোচ্ছে টুকটাক। কেমিস্ট্রির থেকে দিনকে দিনই প্রিয় হয়ে উঠছে সাহিত্য। পার্ট টুতে
সেবার ড্রপ দেওয়ার সেটাও একটা কারণ।
সবে বইয়ের পাতায় লেগে এসেছে মনটা। হালকা একটা চেঁচামেচি কানে আসছিল
কিছুক্ষণ থেকেই। গোড়ায় গা করেনি। কিন্তু থামল না আওয়াজটা। অল্পক্ষণ পরেই মনে হল
মহিলাকণ্ঠে কান্নাকাটির একটানা সুর ভেসে আসছে সত্যজিৎকাকুর বাড়ির দিক থেকে।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠতে হয়েছিল বইটা রেখে। চেঁচামেচি শুরু হওয়ার পরপরই বোধহয় বাড়ি
থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল মা। দোতলার জানলায় যখন গিয়ে দাঁড়িয়েছে সে, তখন ফিরে আসছে
ব্যস্তসমস্ত মুখে। তড়িঘড়ি একতলায় নেমে এসেছিল রঞ্জন।
আজ মনে হয় কেন নেমেছিল। কেন নিতে গিয়েছিল দায়িত্বটা কাঁধে। সেই
দুপুরটাকেও আর ভোলেনি তারপর। কানাই ডাক্তারকে যে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল সে-ই। আসলে
সত্যজিৎকাকুর একমাত্র ছেলে সুরজিৎ তখন শিবপুরের হোস্টেলে। পাড়ায় চ্যাংড়া ছেলে বলতে
সেদিন শুধু রঞ্জন আর বুবাই। দু’জন চলে গিয়েছিল দু’দিকে। সুধাকান্তি মৈত্রর বাড়িতেই
এসেছিল আগে রঞ্জন। আজও মনে পড়ে, বাড়ির কাজের লোকটা গেটের ওধার থেকে মুখ বাড়িয়ে
বলেছিল হাসপাতালে সেদিন চব্বিশ ঘণ্টার ডিউটি ডাক্তারবাবুর। নিরুপায় হয়ে ছুটে
গিয়েছিল কানাই ডাক্তারের কাছে। মিউনিসিপ্যালিটির ডাক্তার কানাইলাল মণ্ডলের
চেম্বারে রুগি হত না। এক-আধজন যেত ফলস মেডিকেল সার্টিফিকেট বানাতে। কিন্তু তখন অত
বাছবিচারের সময় কই? হাঁসফাঁস করতে থাকা সত্যজিৎকাকুর মুখটা ভেসে উঠছিল চোখের সামনে
বারবার।
কানাই ডাক্তারও পুশ করল ইনজেকশনটা আর ডক্টর বুধাদিত্য ব্যানার্জিকে
নিয়ে ঢুকল বুবাইও। আজও আপশোশ করে রঞ্জন। আর পাঁচটা মিনিট আগে যদি ঢুকত বুবাইরা!
আর্মিতে ছিলেন ডক্টর ব্যানার্জি। পাক্কা সাহেবি মেজাজের মানুষ। সব সময় পরনে সাদা
শার্ট ট্রাউজার্স। মরফিয়া পুশ করার কথা শুনেই জিজ্ঞাসা করেছিলেন কানাই ডাক্তারকে,
প্রেশারটা চেক করে নিয়েছেন তো?
ওই যা। প্রেশারটা তো দেখা হল না।
হোয়াট! হ্যাভ ইউ পুশড মরফিয়া উইদাউট চেকিং হিজ প্রেশার?
গতবছর মারা গেলেন কাকিমা। আগের দিন অবধি হেসে কথা বলে গিয়েছেন তার
সঙ্গে। সুরজিৎ এখন জার্মানিতে সেটলড। নিয়ম
করে বছরে একবার করে এসে ঘুরে গিয়েছে। দেখা হলে হেসেই কথা বলেছে বরাবর। কিন্তু
পালটা হাসতে গিয়ে নিজের মনেই খচখচানিটা টের পেয়েছে রঞ্জন।
তারপরে আর একবারই আসা হয়েছিল সুধাকান্তি মৈত্রর বাড়ি। সেও হয়ে গেল
আজ বছর পনেরো। আর্যমার সঙ্গে সম্পর্কটা একে অন্যের বাড়ি যাতায়াত অবধি গড়িয়েছিল।
বর্দ্ধমান থেকে তখন এম এসসি করছে রঞ্জন। সাহিত্যের নেশাটা নিভু নিভু। বরং ভাবতে
শুরু করেছে চাকরিবাকরির কথা। রবিবার বিকেলে আড্ডা মারছিল আর্যমাদের বাড়িতে। আচমকা
হইহই ব্যাপার। কোনও কারণ ছাড়াই বাথরুমে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল উপলদা। জানা গেল
তার আগেও দু’দিন নাকি হয়ে গিয়েছে এমন কাণ্ড। আর্যমার সঙ্গে সেন্সলেস উপলদাকে রিকশায়
তুলে নিয়ে আসা হয়েছিল সুধাকান্তি মৈত্রর বাড়ি। পেছন পেছন পাড়ার দু’-একটা অল্পবয়সী
ছেলের সঙ্গে সাইকেলে রঞ্জন।
চেম্বারের সময় নয় তখন। খবর পাঠানো হল ওপরে। ততক্ষণে ফিরে এসেছে
উপলদার জ্ঞান। তাও সবাই ধরাধরি করে রিকশা থেকে নামিয়ে বসিয়ে দিয়ে আসা হয়েছিল
ভেতরে। এত কাণ্ডের পর বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরিয়েছে রঞ্জন। ফিল্টারের কাছে যখন
চলে এসেছে আগুনটা তখনই হঠাৎ মনে হল গন্ধ নিয়ে কি যাওয়া উচিত হবে আর ডাক্তারের
চেম্বারে? যতই না থাক অন্য রুগি। বাকিরা ঠিকই বের করে আনতে পারবে উপলদাকে। বড়জোর
একচোট ঝাড় খেতে হবে পরে আর্যমার কাছে।
নিজেই হেঁটে বেরিয়ে এসেছিল খানিক পরে উপলদা। একদিকে আর্যমা,
অন্যদিকে তারক বলে পাড়ার একটা ছেলে শুধু ধরেছিল হাত। আর্যমার মুখেই শুনেছিল বছর
দশেক আগে নাকি কলেজে ক্রিকেট খেলার সময় মাথায় ডিউজ বলের ঘা লেগেছিল উপলদার।
সেকেন্ডখানেকের ব্ল্যাক আউট বাদে তখন হয়নি বিশেষ কিছুই। এতদিনে পুরনো সেই চোট শুরু
করছে নার্ভের সমস্যা। পাঁচ মিনিটেই ডায়গনোসিস করে ফেলেছিলেন সুধাকান্তি মৈত্র।
পৌরসভার কাচঢাকা গাড়িটা এসে দাঁড়াল এবার। বেশি
চওড়া নয় গলিটা। লোকজন সামলাতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে বিনোদ। গলির ভেতর আছে একখানা
লাইটপোস্ট। অনেক বছর আগে ওই পোস্টের তলায় দাঁড়িয়েই সিগারেট ধরিয়েছিল রঞ্জন। কোথা
দিয়ে যেন কেটে গেল বছরগুলো। আর্যমাই বা আজ কোথায়। বারাসাতে বিয়ে হয়েছিল মেয়েটার।
তাদের সম্পর্কটা অবশ্য ভেঙে গিয়েছিল আরও আগেই। এক-আধজন কমন ফ্রেন্ডের সুবাদে ক’দিন
আগেই ফেসবুকে আর্যমার প্রোফাইল চোখে পড়েছিল রঞ্জনের। খুলব না খুলব না করেও দমিয়ে
রাখতে পারেনি কৌতূহল। বরের চাকরির সূত্রে হায়দরাবাদে রয়েছে এখন মেয়েটা। অনেক মোটা
হয়ে গিয়েছে। দুই ছেলের মা। বড়টার বয়স সাত-আটের কম হবে বলে তো মনে হল না।
উপলদাকে নিয়ে সেই আসার পর আর কি কখনও আসা হয়নি সুধাকান্তি মৈত্রর
বাড়ি? না, সত্যিই আর আসা হয়নি। আশ্চর্য! মাঝের এই দীর্ঘ সময়পর্বে কতবার সুধাকান্তি
মৈত্রর কাছেই দেখানোর জন্য আরোগ্য, বীণাপাণি বা শিপ্রাতে লিখিয়ে গিয়েছে সে মায়ের
নাম। অথচ আর আসা হল না তারপর জলট্যাঙ্কের
গলিতে। শুধু কি তাই! প্রথম যেন আজই টের পেল রঞ্জন—চল্লিশ বছর একটানা একই মফস্সল
শহরে পাশাপাশি বসবাস করেও আজ অবধি দেখা হয়নি তার সুধাকান্তি মৈত্রর মুখ। আসলে
বরাবর মায়ের নামটুকু লিখিয়ে গিয়েই দায়িত্ব সেরেছে সে। আরোগ্য, বীণাপাণি বা এই
জলট্যাঙ্কের গলিতেও প্রত্যেকবারই মাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে সেবন্তী। এমনকি এই
সামান্য ব্যাপারটুকু টের পেতে পেতেও কেটে গেল এতগুলো বছর।
সরু গলির ভেতর থেকে অনেকেই এবার বেরিয়ে এসে দাঁড়াচ্ছে সামনের চওড়া
রাস্তায়। সম্ভবত আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বের করে আনা হবে সুধাকান্তি মৈত্রকে।
বিনোদকেও আর দেখা যায় না আশেপাশে। হয়তো বাড়ির ভেতর গিয়ে ঢুকেছে ইতিমধ্যে।
নির্মাল্যকে মনে পড়ে যায় আচমকা রঞ্জনের। যাকে বলে অভিন্নহৃদয়
বন্ধুত্ব, ক্লাস টুয়েলভ অবধি তাই ছিল রঞ্জনে-নির্মাল্যতে। হায়ার সেকেন্ডারির পর
ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে সেই নির্মাল্য গেল সিটি কলেজে। রঞ্জন পেল সুরেন্দ্রনাথে
কেমিস্ট্রি। দেখাসাক্ষাৎ কমে গেল একধাক্কায় অনেকখানি। প্রায় মাসখানেক বাদে ট্রেনের
কামরায় দেখা হয়েছিল একদিন। কথায় কথায়
বলেছিল রঞ্জন, আশ্চর্য দ্যাখ, দু’জনেই রোজ যাচ্ছি আসছি ট্রেনে। অথচ দেখা হতে হতে
মাস পেরিয়ে গেল...
কী মনে হয় জানিস! আসলে যার সঙ্গে রোজ দেখা হবে এমনিতেই, হঠাৎ দেখা
হয়ে যাওয়ার প্রোবাবিলিটিও আবার তার সঙ্গেই বেশি।
মানে?
মানে, হেসেছিল নির্মাল্য, কাদের সঙ্গে আজকাল বারেবারেই দেখা হয়ে
যাচ্ছে বল তো তোর?
কাদের সঙ্গে?
যাদের সঙ্গে এমনিতেই দেখা হয় তোর আজকাল। ধর যে প্রফেসররা ক্লাস
নিচ্ছেন তোদের সুরেন্দ্রনাথে। ফেরার সময় ট্রেনে উঠেও হয়তো আচমকা জানলার ধারে বসে
থাকতে দেখছিস তাঁদের। তুই যে ফলো করে আসছিস তা কিন্তু নয়। আপনা-আপনিই হয়ে যাচ্ছে
দেখা...
একজ্যাক্টলি, কথাটাকে প্রায় লুফে নিয়েছিল রঞ্জন, আবার দ্যাখ, একই
সময়ে হয়তো শিয়ালদায় রয়েছিস তুইও। হয়তো ধারেকাছেই। কিন্তু তোর সঙ্গে দেখা হচ্ছে না
কিছুতেই...
অথচ একবছর আগেও এমন আপনা-আপনি কতবার দেখা হয়ে গেছে আমাদেরই...
তারপরেও আর কমই দেখা হয়েছে নির্মাল্যর সঙ্গে। বোধহয় ছেলেটার
সেদিনের কথাটাই ছিল ঠিক। হুট করে পথেঘাটে দেখা হয়ে যায় সেই মানুষগুলোর সঙ্গেই
সচরাচর, রোজের দরকারে এমনিতেই দেখা হবে যাদের সঙ্গে। আবার আচমকা বদলে গেলে
জীবনপ্রবাহের বাঁক দু’দিন আগের সেই দু’ বেলা দেখা হওয়া মানুষগুলোই কেমন আপনা-আপনি
সরে যায় রোজনামচা থেকে। অথবা শুধুই কি মানুষ—জলট্যাঙ্কের গলির মুখে দাঁড়িয়ে
দাঁড়িয়ে মনে হয় রঞ্জনের—জীবনের স্রোত থেকে যেন কবে অজান্তেই সরে যায় আরও কতকিছুই।
হারিয়ে যায় সকাল-সন্ধ্যায় বাঁকে করে বাড়ি বাড়ি জল দিয়ে যাওয়া মানুষদের একটা আস্ত
জীবিকা। হারিয়ে যায় কত যত্নের বিএসএ ডিলাক্স সাইকেল। গল্প লেখার ডায়েরি। দেবাশিস
বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই। বর্ষার বাজারের দেড়-দু’ কিলো ওজনের ইলিশ। প্লট হয়ে বাড়ি হতে
হতে চিরতরে হারিয়ে যায় উপলদাদের ক্রিকেট খেলার মাঠ।
বোধহয় সেভাবেই হারিয়ে গিয়েছে সুধাকান্তি মৈত্রদের যুগটাও। যখন
কল্পনাও করতে পারত না লোকজন ডাক্তারবাবুদের গায়ে হাত তোলার কথা। সমীহ করত খাকি
পোশাকের পুলিশকে। শ্রদ্ধা করত ময়লা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা মাস্টারমশাইকে। ফেসবুক
খুললেই অপরিচিত মানুষেরও ঠিকুজি জেনে ফেলা এই যুগেও বোধহয় তাই রঞ্জনের চোখে অদেখাই
রয়ে গেলেন এত মানুষের পরিচিত সুধাকান্তি মৈত্র।
গলির ভেতর থেকে ঠিক সেই মুহূর্তে ভেসে এসেছিল এক উচ্চকিত হরিধ্বনি।
বের করে আনা হচ্ছিল সুধাকান্তি মৈত্রকে।
গলির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে তড়িঘড়ি সিটে উঠে বসে বাইকের চাবি ঘোরায়
রঞ্জন।
একটা পিরিয়ড ড্রামার মত, অথচ ছোট গল্পের পরিসরে। খুবই সময়োপযোগী।
ReplyDeleteসুধাকান্তি অগ্নীশ্বর নন, উনি সুদাকান্তিই... বিলুপ্তপ্রায় সমাজের টিমটিম করে জ্বলা অংশ।
অসাধারণ।
ReplyDeleteকিছুদিন আগেই এই শহরের এক বৃদ্ধ ডাক্তারবাবু মারা গেলেন। আমার ছেলেবেলার অনেক অসুখ আর উপশমের স্মৃতি আছে তাঁর সঙ্গে। ডাক্তার জিতেন্দ্রনাথ রায়। অনেকটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো দেখতে ছিলেন উনি। রাত একটাতেও পাওয়া যেত। জীবনের শেষদিন অবধি চেম্বার করেছেন। আবেশের গল্পে তাঁকে মনে পড়ে গেল।
ReplyDeleteনা! এটা গল্পই কোনও গুজব নেই এতে। রয়েছে উসকে দেওয়ার মাধুর্য।
ReplyDeleteস্মৃতিকে উসকে দেওয়ার এক চরম মাধুর্য
Deleteওতপ্রোত চেনাশুনো থাকার সময়কার এক না-দেখা আখ্যান। ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া...
ReplyDelete